বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

সানজিদা আক্তার জিপিএ-৫.০০ পেয়েছে


সানজিদা আক্তার সাদিয়া সালনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে psc পরিক্ষা ২০১৬ অংশ গ্রহন করে জিপিএ ৫.০০ পেয়েছে। তার বাবার নাম মোঃ ছানোয়ার হোসেন, মাতার নাম জায়েদা খাতুন। সানজিদা আক্তার সাদিয়া বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। সে সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন। আপনারা সবাই তার জন্য দোয়া করবেন।


সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

জেএসসি পরীক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার, আটক ৪


গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কারখানা বাজার এলাকা থেকে শুক্রবার রাতে নিখোঁজ এক স্কুলছাত্রের মরদেহ সেপ্টিট্যাংকি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বুধবার ট্রাকচালকসহ চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।
নিহত স্কুলছাত্রের নাম আতিকুর রহমান (১৫)। সে সিটি কর্পোরেশনর কাউলতিয়া বিপ্রবর্থা এলাকার আব্দুর রশিদের ছেলে।
এ ঘটনায় ৪ জনকে আটক করা হয়, ট্রাক চালক আব্দুল আলিম (৩২), ইটভাটার শ্রমিক খোরশেদ আলম (২২), শাহিনুর রহমান (২২) ও শফিকুর রহমান টাইগার (২৩)। আটকদের একজনের দেয়া স্বীকারোক্তিতে ঘটনা তদন্তে বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুলিশ কারখানা বাজার এলাকার দেওয়ান ব্রিকস-এ অভিযান চালিয়েছে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ঐ এলাকার জনগণ জানান, আতিক স্থানীয় বিপ্রবর্থা এলাকার আব্দুর রশিদের ছেলে। সে কাউলতিয়া জহির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে ওই ভাটার ট্রাকে শ্রমিকের কাজ নেয়।
শুক্রবার রাতে আতিক ইটভাটার উদ্দেশে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। আতিক নিখোঁজ হওয়ার পর সোমবার দুপুরে তার সঙ্গে থাকা ওই চারজনকে ডেকে স্থানীয়দের নিয়ে শালিস করা হয়। এ সময় তারা একেকবার একেক তথ্য দিলে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। পরে তাদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
জয়দেবপুর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাহমুদুল হাসান তাদের আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, শনিবার ভোরে আটকদের সঙ্গে স্কুলছাত্র আতিকুর রহমান (১৫) একটি ট্রাকে ইট লোড করার পর ওই ট্রাকে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

পরে ঢাকার আজিমপুর এলাকায় ইট আনলোড করার সময় দুর্ঘটনায় (ট্রাকের ঢালার আঘাতে) আতিক মারা যায়। সেখান থেকে তার মরদেহ এনে ইটভাটার মালিক ইমরান দেওয়ানের কাছে হস্তান্তর করে বলে জানায় আটক শাহীনুর।
আটকদের দেয়া তথ্যানুযায়ী বুধবার ওই ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়েছে। ইটভাটার মালিক ইমরান ও ম্যানেজার রফিকুল ইসলামকে সেখানে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে তারা পলাতক রয়েছেন। তাদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান থানা পুলিশের এ পরিদর্শক।


রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন অগ্রগণ্য সেনানায়ক


১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতে জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন মেজর। সে রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাসরত পাকিস্তানি এক জেনারেলের কাছে তাঁকে পাঠানো হচ্ছিল। পরিকল্পনা ছিল তাঁকে ‘গ্রেপ্তার বা হত্যা’ করার (গোলাম মুরশিদ, মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস)।
পথিমধ্যে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সংবাদ শোনামাত্র বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে এসে তাঁর কমান্ডিং অফিসারসহ অন্যান্য পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যকে বন্দী করেন। পরদিন তিনি প্রাণভয়ে পলায়নপর মানুষকে থামিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনাময় ভাষণ দিতে শুরু করেন (বেলাল মোহাম্মদ, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র)। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি বেতারে নিজ কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
জিয়ার এই রূপান্তর বা উত্থান বিস্ময়কর হতে পারে, কিন্তু তা আকস্মিক ছিল না। বরং বাংলাদেশের মানুষের বঞ্চনা, স্বাধীনতার স্বপ্ন, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একজন সৈনিককেও কীভাবে উদ্দীপিত করেছিল, এটি ছিল তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত (জিয়াউর রহমান, ‘একটি জাতির জন্ম’)।
জিয়া ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন অগ্রগণ্য সেনানায়ক। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের একজন ছিলেন। ৪৯ জন যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাকে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। তিনি তাঁদের একজন ছিলেন। কিন্তু তিনি সেক্টর কমান্ডার ও বীর উত্তম খেতাবধারীদের মধ্যেও অনন্য ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে। ২৭ মার্চ এই ঘোষণা ‘মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের’ পক্ষে তিনি প্রদান করেন কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে।
এরপর জিয়া চট্টগ্রাম যুদ্ধাঞ্চল, ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে বহু আলোচিত যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করেন। যুদ্ধের শেষ ভাগে সিলেট অঞ্চলে তাঁর বাহিনীর কাছেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তিনি সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের, এম এ জলিল বা খালেদ মোশাররফের মতো সম্মুখযুদ্ধের অসীম সাহসী যোদ্ধা ছিলেন না। সমশের মবিন চৌধুরী ও হাফিজ উদ্দিনের ন্যায় তাঁর নিজস্ব বাহিনীর অফিসারদের মতো তিনি যুদ্ধ করতে গিয়ে আহতও হননি। কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী যুদ্ধে তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম শক্তিশালী প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে, কিছু ক্ষেত্রে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।
জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাঁর আগে মাওলানা ভাসানী স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ছাত্রনেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান দিয়েছিলেন ও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন, এ জন্য সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি ২৫ মার্চ কাল রাতের পর জিয়ার আগেই চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নান বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন কারণে জিয়াউর রহমানের ঘোষণার তাৎপর্য ছিল অন্য রকম।
প্রথমত, শক্তিশালী সম্প্রচারকেন্দ্রে বারবার সম্প্রচারিত হওয়ার ফলে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটিই কেবল দেশের সব অঞ্চল থেকে বহু মানুষ শুনতে পেয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের মুখে দিশেহারা ও পলায়নপর অবস্থায় এটি মানুষের কাছে পরম ভরসার বাণী হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, জিয়ার ঘোষণাটি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন বিদ্রোহী বাঙালি অফিসারের এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে। এটি মানুষকে প্রতিরোধের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রবলভাবে আশান্বিতও করেছিল।
মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকার ২০০২ সালে এক স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের কথা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি, যুদ্ধের পরবর্তী সময়েও জানি যে মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারা দেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, হ্যাঁ, এইবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামল।’ (এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন)। জিয়ার ঘোষণায় উৎসাহিত বা উদ্দীপিত হয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি), এইচ টি ইমাম (বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১), অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের (আমার একাত্তর) মতো আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও। তাঁর ঘোষণার গুরুত্বের উল্লেখ আছে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সক্রিয় কূটনীতিক জে এন দীক্ষিতসহ ট্রেভর ফিসলক, ডেভিড লুডেনের মতো বহু আন্তর্জাতিক ব্যক্তিদের ভাষ্যে (মাহফুজ উল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ)।
তবে মনে রাখতে হবে, জিয়ার ঘোষণাটির অতুলনীয় প্রভাব পড়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে এটি দেওয়া হয়েছিল বলে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মঈদুল হাসান লিখেছেন, ‘মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় (২৭ মার্চ সন্ধ্যা) নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় নেতাদের পরামর্শক্রমে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিদের্শে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। এই সব ঘোষণা লোকের মুখে মুখে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে, শেখ মুজিবের নির্দেশে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিরা স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই শুরু করেছে।’ (মূলধারা ’৭১)
২. ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি অফিসারদের কাছে কোনো সুস্পষ্ট বা সরাসরি নির্দেশ ছিল না। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তানের শাসনভার প্রদানে অনীহার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা সচেতন ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীতে তাঁদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনা নিয়েও প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল (রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে)।
এ কারণে তাঁদের অনেকেই ২৫ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার সংবাদ শোনামাত্র বিদ্রোহ করেন। বাঙালি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে জিয়া বিদ্রোহ করেন সবার আগে (মুরশিদ, পূর্বোক্ত)। ২৮ মার্চের মধ্যে বিদ্রোহ করেন সেক্টর কমান্ডারদের প্রায় সবাই। কিন্তু তাঁদের বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহকে সমন্বিত, সুশৃঙ্খল ও কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা এবং এটিকে পরিপূর্ণ একটি স্বাধীনতাযুদ্ধে পরিণত করার ব্যাপারে জিয়াসহ প্রত্যেকে সচেতন ছিলেন। যুদ্ধের সময়কালে বিভিন্ন ঘটনায় তাঁদের এই অসাধারণ প্রজ্ঞা, দায়িত্ববোধ ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া। এবং এখানেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমরা জিয়াকে অনন্য বা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে দেখি। প্রথমত, ৩ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার ঠিক পরদিন জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, কে এম সফি উল্লাহসহ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর কমান্ডাররা তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে বৈঠক করেন। সেখানে তাঁরা ভারতের সামরিক সাহায্য এবং দেশের রাজনীতিবিদদের নিয়ে স্বাধীন সরকার গঠনের আবশ্যকতা প্রশ্নে একমত হন, বিদ্রোহী ইউনিটগুলো নিয়ে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ গঠন করেন এবং এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে স্থির করেন। ৪ এপ্রিলের এই বৈঠকই ছিল বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর প্রথম সাংগঠনিক ভিত্তি।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ সরঞ্জামের অভাব, কেন্দ্রীয় কমান্ডের নিষ্ক্রিয়তা এবং কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানে ভারতের বিলম্বের কারণে একাত্তরের মে থেকে জুলাই মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত হতোদ্যম পরিস্থিতিতে যুদ্ধাঞ্চলের অধিনায়কদের এক সম্মেলনে জিয়াই নতুন চিন্তা নিয়ে আসেন। ১০ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত মুক্তি বাহিনী সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এর সূচনায় মুক্তিযুদ্ধের অধোগতি রোধ ও যৌথ কমান্ড-ব্যবস্থায় যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন জিয়া। তাঁর এই প্রস্তাবে একজন বাদে বাকি সব সেক্টর কমান্ডারের সম্মতি ছিল। মিন্ত্রসভার সমর্থন থাকলে এটি যুক্তিসংগত বলে মেনে নিতে পারতেন তাজউদ্দিন। তাতে যুদ্ধ আরও গতিশীল হতে পারত (এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন)। তবে সেই সম্মেলনে গেরিলাযুদ্ধের পাশাপাশি সম্মুখসমর, মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তুতি হিসেবে ব্রিগেড গঠনের যে সিদ্ধান্ত হয়, তা রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকেই।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে মেজর জেনারেল কে​ ভি কৃষ্ণ রাওয়ের সঙ্গে জেড ফোর্স কমান্ডার জিয়াউর রহমান (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ​ছবি: সংগৃহীত
তৃতীয়ত, জুলাই মাসের এই সম্মেলনে জিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিগেড গঠনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া হলেও পরে কর্নেল ওসমানীর একক সিদ্ধান্তে আরও দুটি ফোর্স গঠিত হয় (এ কে খন্দকার, পূর্বোক্ত)। জেড ফোর্স নামে পরিচিত জিয়ার ব্রিগেড একাত্তরে দ্রুত কাজ শুরু করে। ঢাকামুখী অভিযানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটিতে তারা ৩১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট কয়েক দফা হামলা চালায়। ১ আগস্ট জেড ফোর্স বাহাদুরবাদ এবং ৩ আগস্ট শেরপুরে নকশি বিওপিতে আক্রমণ করে। এসব দুঃসাহসিক সম্মুখসমরে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। কামালপুর যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। জিয়াকে এ জন্য কিছু সমালোচনাও মেনে নিতে হয়। কিন্তু এসব যুদ্ধ মুক্তি বাহিনীর সামর্থ্য ও সাহসিকতা সম্পর্কে নতুন উপলব্ধির জন্ম দেয়।
চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে জিয়াকে আমরা দেখতে পাই সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণাত্মক যুদ্ধের অধিনায়ক হিসেবে। একাত্তরের অক্টোবরে যৌথ সামরিক নেতৃত্ব গঠনের পর যুদ্ধের নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব চলে যায় ভারতের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে। নভেম্বরে ভারতীয় বাহিনী নিজ দেশের সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাংলাদেশের সেক্টর ও ফোর্সগুলো আরও মুহুর্মুহু আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ওসমানীর নিদের্শ অক্টোবর মাসে পুরো জেড ফোর্স নিয়ে মেজর জিয়া চলে আসেন সিলেটে। এর তিনটি ব্যাটালিয়ন শ্রীমঙ্গল, ছাতক ও কুলাউড়ায় অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা ও ক্যাম্পে সরাসরি হামলা চালায়। ১০ ডিসেম্বর এই ফোর্স সিলেট আক্রমণ শুরু করে। ১৪ তারিখ তারা সিলেটে প্রবেশ করে। যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তিনি একদিন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, সিলেটে ১২৫ জন অফিসার, ৭০০ সৈন্যসহ সেই বাহিনীর একটি অংশ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান ছিল অপরিসীম। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করা ছাড়াও যুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধ প্রশাসনের নীতি-নির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। জিয়া ছিলেন এই যুদ্ধে মহানায়কের মতো আরও ছিলেন খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, আবু ওসমান, এম এ জলিল, রফিকুল ইসলামসহ অন্যান্য সেক্টর কমান্ডাররা। মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি ছিল একটি জনযুদ্ধ, বহু সাধারণ মানুষের অসাধারণ আত্মত্যাগ আর শৌর্যবীর্যের এক অনুপম গৌরবগাথা।
বাংলাদেশের এই বীর সন্তানেরা ছিলেন অত্যুজ্জ্বল এক নক্ষত্রমণ্ডলীর মতো। সে নক্ষত্রমণ্ডলীর সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধুই। কিন্তু তাই বলে অন্য কোনো নক্ষত্রের আলোও ম্লান হতে পারে না, অন্য কোনো নক্ষত্রও মুছে যেতে পারে না।
জিয়া আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের এমনই এক অবিনশ্বর নক্ষত্র। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শুধু জিয়া নন, আরও অনেকের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে পেক্ষ–বিপক্ষে নানা আলোচনা রয়েছে। কিন্তু সেটি তাঁদের একাত্তরের ভূমিকাকে ম্লান করতে পারে না।
লেখক- আসিফ নজরুল। অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

হাইকোট বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ক্ষেত্রে ৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন

হাইকোট বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ক্ষেত্রে ৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন


বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আওতায় আনার ক্ষেত্রে ৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোট। বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি এ কে এম শহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈতবেঞ্চের পুর্ণাঙ্গ রায়ে জাতীয়করণের জন্য অনুসরণীয় এসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ইংরেজিতে ২০ পৃষ্ঠার রায়ে “শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ নীতিমালা” শিরোনামের অংশটি বাংলায় লেখা হয়। ওই রায়ে বলা হয়, “ভবিষ্যতে কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করতে হলে নিন্মোক্ত নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।” গুলশানের কালাচাঁদপুর স্কুল এন্ড কলেজ জাতীয়করণ সংক্রান্ত ওই মামলাটি ওয়াকিল উদ্দিন ও অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র হিসেবে বহুল আলোচিত।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করা হলেঃ-
১.উক্ত প্রতিষ্ঠানের শুধু সে সকল কর্মরত শিক্ষকগণকে সরকারী চাকরিতে আত্মীকরণ করা হবে যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বি সি এস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে নিযুক্তির জন্য নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতার অনুরূপ।
২. আত্মীকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে প্রথমে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে এবং পরবর্তীতে সরকারী কর্ম-কমিশন কর্তৃক তার উপযুক্ততা যাচাইয়ের পর কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়মিত নিয়োগদান করা হবে।
৩.মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও যে সকল কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শিক্ষাগত যোগতা বিধি অনুসারে সরকারি বিদ্যালয়ে নিযুক্তির জন্য নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতার অনুরূপ, শুধু তাদেরকেই উপযুক্ততা যাচাইয়ের পর আত্মীকরণ করা হবে। তদানুযায়ী আত্মীকরণ বিধিমালা সংশোধন করা হবে।
৪. কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি অন্তত: দশ বৎসর নিয়মিত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত না হয়ে থাকে সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জন্য বিবেচিত হইবে না।
৫.জাতীয়করণের জন্য এলাকার প্রাধিকার নির্ধারণ, জনসংখ্যা ও তথায় বিদ্যমান শিক্ষার সুযোগ পর্যালোচনার ভিত্তিতে করতে হবে। জাতীয়করণের জন্য প্রস্তাবিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে পূর্ববর্তী পাঁচ বৎসরের পাবলিক পরীক্ষায় উৎকৃষ্ট ফলাফল অর্জনকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের জন্য বিবেচনা করা হবে।
৬.যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র/ছাত্রী পূর্ববর্তী পাঁচ বৎসরের মধ্যে পরীক্ষায় দূর্নীতির জন্য বহিস্কৃত হয়েছে সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জন্য বিবেচিত হবে না।
৭.জাতীয়করণ করা হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে; জাতীয়করণের পর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আত্মীকৃত শিক্ষক/শিক্ষিকাগণ ন্যূনতম ৫ (পাঁচ) বৎসর উক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করতে বাধ্য থাকবেন।
৮.মাধ্যমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে সুযোগ বৃদ্ধি ও গুণগত উৎকর্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি উপজেলায় অন্তত: একটি করে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সরকারি নীতি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। বর্তমানে যে সকল উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই, শুধু সে সকল উপজেলার বিদ্যালয় কোনো বেসরকারি বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ অথবা নতুন স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে এ নীতি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। উপজেলার এ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকে একটি মডেল বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক/শিক্ষিকা নিয়োগ ইত্যাদির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এর ফলশ্রুতিতে উপজেলায় অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুপ্রেরণা লাভ করবে এবং এদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করবে। সরকারি সম্পদের সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে দশ বৎসর মেয়াদের সময়সীমা নির্ধারণ করে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।


শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬

অনার্স ও মাস্টার্স শিক্ষকদেরকে কেন এমপিও দেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে না

অনার্স ও মাস্টার্স শিক্ষকদেরকে কেন এমপিও দেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে না


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজের অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে কর্মরত ননএমপিওভুক্ত ৯৮ জন শিক্ষককে এমপিও প্রদানে এমপিও নীতিমালায় কেন প্রয়োজনীয় সংশোধনীর নির্দেশনা দেয়া হবে না এবং একই সাথে কেন ওই ৯৮ জনকে এমপিও প্রদানের নির্দেশনা দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এক রিট আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬,রোজ বুধবার এই আদেশ দেন। শিক্ষা সচিব, আইন সচিব, অর্থ সচিব ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ বিবাদিদের আগামি ৪ সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক সমিতির পক্ষে রিট আবেদন করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্যাহ মিয়া। সরকার পক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান।
রিট আবেদনে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সবাই বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারি এমপিও নীতিমালা ২০১৩ অনুসারে এমপিও পাচ্ছেন। কিন্তু একই কলেজে কর্মরত অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ এমপিও পাচ্ছেন না। তাই এমপিও নীতিমালায় সংশোধনী এনে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে কর্মরত শিক্ষকগণকে এমপিও প্রদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করা হয়।
তবে একাধিকবার এমপিও নীতিমালা সংশোধন করা হলেও অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ব্যাপারে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি। তাই নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধনীর নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদনটি করা হয়। আদালত শুনানি শেষে রুল জারি করেছেন। রিটকারীদের সবাই বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক সমিতির সদস্য এবং তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে শিক্ষকতা করছেন।

অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকরা দীর্ঘদিন যাবত এমপিওভুক্তির দাবীতে আন্দোলন করেছেন। এখন আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
জানতে চাইলে নন-বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক সমিতির সভাপতি নেকবর হোসাইন জানান, রিটের মাধ্যমে আমরা আমাদের ন্যায্য দাবী আদায়ের চেষ্টা করছি। রুল জারি করায় খুবই খুশী হয়েছেন সারাদেশের কয়েকহাজার নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ও তাদের পরিবার।


বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬

জাতীয়করণ নিয়ে সংকট সারা দেশে| আমার দেশ

জাতীয়করণ নিয়ে সংকট সারা দেশে


যাঁদের লাঠিপেটায় বাবা মারা গেছেন, তাঁরা যত ক্ষমতাবান আর প্রভাবশালীই হোন না কেন, দেশের আইনের চেয়ে তাঁরা বড় নন। আমি এই হত্যার বিচার চাই।’ কান্নায় ভেঙে পড়ে কথাগুলো বলছিলেন সামিহা আজাদ। তাঁর বাবা আবুল কালাম আজাদ ফুলবাড়িয়া কলেজের শিক্ষক। ওই কলেজ জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনের একপর্যায়ে গত রোববার পুলিশের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে মারা গেছেন তিনি।

জাতীয়করণ নিয়ে এই সংকট শুধু ফুলবাড়িয়া কলেজকে ঘিরে নয়। নীতিমালা ও নতুন নিয়োগবিধি ছাড়াই একসঙ্গে দেশের তিন শতাধিক বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করতে গিয়ে এই বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঘোষিত মানদণ্ড না থাকায় ভালো ও পুরোনো কলেজ বাদ দিয়ে যেনতেন বেশ কিছু কলেজ জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন হচ্ছে। পাবনার সুজানগরে গত সোমবার একটি কলেজকে জাতীয়করণের দাবিতে হরতালও পালন করেছেন ওই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ইতিমধ্যে জাতীয়করণ হওয়া এবং প্রক্রিয়াধীন কলেজগুলোর বিরাটসংখ্যক শিক্ষককে বিসিএস ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে আরেক ধরনের জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা ঘোষণা দিয়েছেন, এসব শিক্ষকের বিসিএস ক্যাডারে আত্তীকরণের বিষয়টি তাঁরা মানবেন না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আগে কলেজ জাতীয়করণ হওয়ার আগে সেগুলো পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠাত অধিদপ্তর। সেটা আবার যাচাই-বাছাই করে দেখা হতো। কিন্তু এবার পরিদর্শন প্রতিবেদন ছাড়াই শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি কলেজ নেই, সেসব উপজেলার কয়েকটি করে কলেজের নাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায়। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সেখান থেকে জাতীয়করণের জন্য কলেজগুলোর নাম চূড়ান্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব কাজ করেছে বলে অভিযোগ আছে।
.মাউশির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছিল, কলেজ জাতীয়করণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। এর ভিত্তিতে মাউশি একটি নীতিমালার খসড়াও করে দিয়েছিল। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী করেছে, সেটা আর তিনি জানেন না। গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, নীতিমালা হলে তো সবাই দেখত ও জানত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের কাজে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি কলেজ নেই, সেসব উপজেলার সম্ভাব্য কিছু কলেজের নাম মাউশির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। পরে সেগুলোই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। তবে নীতিমালা আগেও ছিল না। এ বিষয়ে মাউশির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আগে জাতীয়করণ হলেও তখন দু-একটি ভালো ও বড় কলেজকে জাতীয়করণ করা হয়েছে। এর ফলে সমস্যা হয়নি। কিন্তু এবার যেনতেন কিছু কলেজ তালিকায় ঢুকে যাওয়ায় সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ বিতর্কিত হয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত সোমবার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব উপজেলায় সরকারি স্কুল ও কলেজ নেই, সেখানে একটি করে স্কুল-কলেজ সরকারি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জন্য এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৩৮টি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পাঁচটি ও চলতি বছর ১২টি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়। ওগুলো বাদে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক তালিকায় ১৯৯টি এবং আরেক তালিকায় ২৩টি বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণের ব্যবস্থা নিতে তালিকাভুক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব মিলিয়ে ৩১৩টি উপজেলায় একটি করে কলেজ জাতীয়করণ করা হবে। বর্তমানে সরকারি কলেজ ৩২৭টি। এগুলো চূড়ান্ত হলে মোট সংখ্যা দাঁড়াবে ছয় শতাধিক। ইতিমধ্যে দুই দফায় দেওয়া তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কুষ্টিয়া, মাগুরা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলার কিছু উপজেলায় বড় ও পুরোনো কলেজ বাদ দিয়ে যেনতেন কলেজ জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো কলেজ আছে যেগুলোতে মাত্র দু-একজন পরীক্ষা দিয়ে কখনো সবাই ফেল কিংবা কখনো একজন পাস করেছেন। আবার কোনো কোনো কলেজ এমপিওভুক্তই হয়নি, তারপরও সেগুলোকে জাতীয়করণ করা হচ্ছে। এ নিয়ে এর আগে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ডিগ্রি কলেজ বাদ দিয়ে উপজেলা থেকে দুই কিলোমিটার দূরের আরেকটি কলেজ জাতীয়করণ করা হচ্ছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন এই কলেজ থেকে চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় চারজন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করেননি।

১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ থেকে ২০১৫ সালে একজন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। জাতীয়করণের তালিকায় থাকা মাগুরার মহম্মদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান কলেজ এমপিওভুক্তই হয়নি। অথচ এই উপজেলায় ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আমিনুর রহমান কলেজে শিক্ষার্থী ১ হাজার ৪০০। কিন্তু কলেজটি জাতীয়করণের তালিকায় নেই। সিরাজগঞ্জের তাড়াশেও এমপিওভুক্ত নয় এমন একটি কলেজকে জাতীয়করণের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। বাদ পড়েছে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত তাড়াশ ডিগ্রি কলেজ, যেখানে শিক্ষার্থী প্রায় দুই হাজার। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজকে বাদ দিয়ে নন-এমপিওভুক্ত সাইফুর রহমান কলেজ জাতীয়করণ করা হচ্ছে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সরিষাবাড়ী কলেজকে বাদ দিয়ে নতুন একটি কলেজকে জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক বিবেচনাসহ কোথাও কোথাও স্থানীয় সাংসদ বা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে যেনতেন কিছু কলেজ জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অর্থের লেনদেন হওয়ারও অভিযোগ আছে। এর প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে এবং হচ্ছে। পাবনাসহ কোথাও কোথাও হরতাল হয়েছে।
সর্বশেষ গত রোববার ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া কলেজকে জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ওই কলেজের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদসহ দুজন নিহত হয়েছেন। আন্দোলনের মুখে টাঙ্গাইলসহ দু-একটি এলাকায় কলেজ পরিবর্তনও করা হয়েছে। মাউশির সাবেক মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুনও মনে করেন, কোনো কোনো জায়গায় স্থানীয় সাংসদের প্রভাবে বড় কলেজ বাদ পড়েছে। তবে তিনি মনে করেন, সরকারি হলে শিক্ষকেরা যেহেতু সরকারি হয়ে বেশি লাভবান হবেন, সে জন্য কোথাও কোথাও তাঁরা আন্দোলনকে উসকে দিচ্ছেন। সর্বশেষ গত রোববার ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া কলেজে সহিংস ঘটনার পর বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়সহ অনেককেই নাড়া দেয়। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ফুলবাড়িয়া কলেজে শিক্ষার্থী ৫ হাজার ৩০০। এখানে সাতটি বিষয়ে স্নাতকও (সম্মান) পড়ানো হয়। সেটিকে বাদ দিয়ে তুলনামূলকভাবে নতুন একটি উচ্চমাধ্যমিক কলেজকে জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় সাংসদ মোসলেম উদ্দিনের প্রভাবেই বড় কলেজটি বাদ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য সাংসদ গত রোববার এই অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে তিনি উপজেলা সদরের তিনটি কলেজের নামের তালিকা দিয়েছিলেন, সেখান থেকে সরকার একটিকে তালিকাভুক্ত করেছে।
ঘটনার পর গত সোমবার মাউশির ময়মনসিংহ অঞ্চলের পরিচালক মো. আবদুল মোতালেব মাউশিতে পাঠানো প্রতিবেদনে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলমান থাকলেও স্থানীয় সাংসদসহ জনপ্রতিনিধিরা এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়নি।
প্রবীণ শিক্ষকনেতা কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, নীতিমালা না থাকার কারণেই অপরিকল্পিতভাবে কলেজ জাতীয়করণ করতে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ জন্য প্রকাশ্য ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করতে হবে। প্রকাশ্য নীতিমালা থাকলে বোঝা যেত কোন কলেজটি জাতীয়করণের জন্য যোগ্য।

শিক্ষকদের নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির আশঙ্কা: বিদ্যমান বিধিমালা বাস্তবায়ন হলে জাতীয়করণের অপেক্ষায় থাকা কলেজগুলোর প্রায় আট হাজার শিক্ষক বিসিএস ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হবেন। এ জন্য এই প্রক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) অধীনে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, ১৫-২০ বছর ধরে বেসরকারি কলেজগুলোতে কীভাবে ও কারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, সেটা কমবেশি সবাই জানেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের টাকা দিয়ে বা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। এটা সরকারও স্বীকার করে। এ জন্য সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ রকম বাস্তবতায় ওই সব কলেজের প্রায় আট হাজার শিক্ষককে বিসিএস ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হলে যাঁরা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। এ বিষয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি ঘোষণা দিয়েছে, জাতীয়করণ হওয়া কলেজশিক্ষকদের বিসিএস ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি তাঁরা মানবেন না। তাঁদের দাবি, এসব শিক্ষককে নন-ক্যাডারে রেখে চাকরি শুধু জাতীয়করণ হওয়া কলেজগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সমিতির মহাসচিব শাহেদুল খবীর বলেন, আত্তীকরণ হওয়া শিক্ষকদের চাকরি আলাদা রাখতে হবে, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। তবে জাতীয়করণ হওয়া কলেজশিক্ষকেরা বলছেন, ‘জনস্বার্থে’ তাঁদের কলেজকে জাতীয়করণ করছে সরকার। সুতরাং জাতীয়করণ হওয়ার পর তাঁদেরও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক সমিতির কয়েক জন নেতা বলেন, দেশে উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষে সরকার ১৯৯৩ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু করেন কিন্তু অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের আজও এমপিও ভুক্ত করেনি। তারা আন্দোলন করেও দাবী আদায় করতে পারিনি তাই রিট করেছে। আজ তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে।তারা বলেন শিক্ষক হত্যার বিচার চাই। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, সব শিক্ষকের মর্যাদা যেন রক্ষা হয়, তা বিবেচনা করেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।